মুসলমান আলাউদ্দিন খাঁ’র বাঙালিজনিত সমস্যা

আমার কথা। অনুলেখক শুভময় ঘোষ। মূল্য ৮০রুপি। পৃষ্টা ৭৮। 

১৯৫২ সালে আলাউদ্দিন খাঁ দুইমাস আছিলেন বিশ্বভারতীতে, তখন উনি যে কথা বলছিলেন, সেইটার উপর ভিত্তি কইরা শুভময় ঘোষ (সাগরময় ঘোষের ছোটভাই) এই বই লিখছিলেন। ১৯৫২ সালে শুভময় ঘোষের বয়স ২৩ বছর ছিল।

সেই বইটার দুইটা প্যারাগ্রাফ নিয়া একটা কথা বলতে চাইতেছি। আগে টেক্সটটা পড়ি, আসেন –

‘আমি বাঁহাতে সরোদ বাজাই। রামপুরে ৪ বছর ডান হাতেই শিখেছি। রামপুর দরবারে অনেকে খুব ঠাট্টা করত আমাকে। “বাঙালী ধুতিখোর, মচ্ছিকে পানি পীনেওয়ালা -” রোজ এই চলত। মাস দু এক গেল, চুপচাপ শুনলুম। বেহালা ভাল বাজাই – ওরা জ্বলে। আর ঠাট্টা করে – “মচ্ছিকে পানি পীনেওয়ালা। ওসব খেলে গান বাজনা হয় না।” ব্যান্ড মাস্টার বলতেন “না না, অমন বল না। বাঙালীর জোড়া মাথা আর নেই। আল্লাউদ্দীন কেমন নোটেশন জানে। তুমি গাও এক মিনিটে শুনিয়ে দেবে।” ওরা শুনে বলে, “কেয়া, নোটেশন মে গান হোতা হায়?” আমার তখন আর সহ্য হয় না, বল্লাম, “আপকো বাপকো পিয়া হ্যায়।” ওরা তবুও ছাড়ে না – “মাছ খাও?” “মাছ ত পাই না। ছোলা খেয়ে থাকি। পয়সা কোথায়?” “নোকরী কর। এসব খেয়ে কি সরোদ বাজান যায়, গান গাওয়া যায়?” “তবে কী খাব? হাতীঘোড়া?”

“গোস্ত খাও। পোলাও, বিরিয়ানী।” “গোস্ত গোমাংস আমি খাই না।” “ও কি হিন্দু নাকি?” এই রকম ঝগড়া রোজই প্রায় হয়। একদিন জামিরুদ্দীন আর আরও কয়েকজন – ফাজিল সব জুটেছে। আমায় নিয়ে খুব ঠাট্টা চলছে। জামিরুদ্দীন বলছে, “গোস্ত খাও, বাজাও। মচ্ছিকে পানি মে কুছ্ নেহি হোগা।” শুনেই মেজাজ চড়ে গেল আমার, “শূয়রের বাচ্চা – কী শুনতে চাও। বাজনা নেহি হোগা? পায়ে ধরে সরোদ বাজাব। শুনবি? মা স্বরস্বতীর জিনিস, তাই পায়ে ধরব না। বাঁ হাতে বাজিয়ে শোনাব।” জামিরুদ্দীন বলে, “হিন্দুর মত কথা বল কেন?” “আমরা ত হিন্দুই ছিলুম।” “কাফের।” কাহাঁতক সহ্য করা যায়। হ্যাঁ শূয়োরের বাচ্চাই বলেছিলাম। সেই থেকে বাঁ হাতে তারের যন্ত্র, ডান হাতে চামড়ার যন্ত্র বাজাই। থাপ্পড়ও বাঁ হাতে মারি। বাঙালীর মেজাজ। রাজাকেও মেরেছিলাম। আঙুল মচকে গিয়েছিল রাজার থাপ্পড় খেয়ে। বাঙালীকে শান্ত দেখেন – রেগে গেলে বোমা মারে। (পৃষ্টা ৫৮ – ৫৯)

এই টেক্সটরে সত্যি ধইরা বলা যায় যে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’রে মুসলমানের মর্যাদা দিতে চাইতেন না, উনার কলিগরা; বাঙালি হওয়ার কারণে। বাঙালি হিসাবে উনার খাদ্য-অভ্যাস এবং বাঙালি হইয়াও প্রতিভাবান হওয়া –  দুইটা কারণই ছিল।

খাঁ সাহেবের হিন্দু হইতে কোন সমস্যা নাই, আদিতে তিনি হিন্দুই ছিলেন (আরবের মুসলমানরাও অন্য ধর্মের এবং স্পেনের মুসলমানরা খ্রীষ্টান ও অন্য ধর্মের আছিলো), সুতরাং এখন মুসলমান হইলেও হিন্দু-অভ্যাস তাঁর মধ্যে থাকতেই পারে। মুসলমান বা হিন্দু হওয়ার চাইতে সঙ্গীতকার হওয়াটাই তাঁর কাছে মুখ্য ব্যাপার; কিন্তু মনে হইতে পারে যেন, বাঙালি হওয়াটারেই উনি মুখ্য ধইরা নিতেছেন। হিন্দু বইলা একটা ধর্ম-অভ্যাস এবং মুসলমান বইলা আরেকটা ধর্ম-অভ্যাসের ব্যাপারে তিনি অসচেতন হইতে চান নাই বা নাই কইরা দেন নাই; বলছেন হিন্দুই ছিলাম (ছিলুম)। কিন্তু এই টেক্সটের পাঠক এই ব্যাপারে অসচেতন থাকতে পারেন, ইজিলি। Continue reading

শাহবাগ ৩

শাহবাগ এর ২১ তারিখের ঘোষণার পর এই আন্দোলন আরো বেশি মিডিয়ার এবং আওয়ামী লীগের দখলে চইলা গেছে। এই সম্ভাবনার ভিতর শাহবাগ সবসময়ই ছিলো। কিন্তু শাহবাগ শুরু হইছিলো মিডিয়ার রিয়ালিটির বাইরে (যদিও মিডিয়া এইটারে কব্জা করতে খুববেশি সময় নেয় নাই) এবং সরকারের বিরোধিতায় (যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে রাজনৈতিক ছাড় দেয়া হইতেছে); আর এখন পরিণত হইতেছে একটা মিডিয়া রিয়ালিটিতে এবং সরকারি আন্দোলনে। এইটারে এই আন্দোলনের রাজনৈতিক ব্যর্থতা হিসাবেই দেখা সম্ভব। আওয়ামী ডিলেমার বাইরে শাহবাগ এর অন্য তেমন কোন রাজনৈতিক অপশন এখনো নাই। থাকাটা সম্ভব যদি শাহবাগ নিজেই একটা পলিটিক্যাল আইডেন্টিটি হয়া উঠতে পারে। [pullquote][AWD_comments width=”294″][/pullquote]

অবশ্য শাহবাগের রাজনৈতিক মিত্র এবং শত্রু সবাই এইটাই চাইছে যে, শাহবাগ যেন বর্তমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে কোন অবস্থান তৈরি করতে না পারে। কারণ, শাহবাগের অবস্থান এমন কিছু রাজনৈতিক প্রশ্নরে সামনে নিয়া আসে যারে রাজনৈতিক দলগুলা সরাসরি ডিল করতে প্রস্তুত না, এইটা উনাদের রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে। এর মধ্যে ত অবশ্যই অন্যতম, মুক্তিযুদ্ধ এবং ইসলাম। এইটা শুধুমাত্র শাহবাগ-ই না, বাংলাদেশের ইন্টেলেকচুয়ালিটিরও মূল জায়গা।

Continue reading

মুসলমান বাঙালি এবং হিন্দু বাঙালি

 

ভয়ংকর একটা বই পড়তাছি; বইটার নাম: মুসলমান বাঙালির লোকাচার (ছাপা হইছে ইন্ডিয়া রাষ্ট্রের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা শহর থিকা, ঢাকাতে বিক্রি হয়), লেখক হিন্দু বাঙালি একরাম আলি। মানে, নাম মুসলমান হইলেও ধর্মে তিনি হিন্দু, যেমন তেঘরিয়া’র মানুষেরা ধর্মে মুসলমান হইলেও লোকাচার, মানে মূল আইডেন্টিটি যেমন হিন্দু’র। তিনটা বাক্য বলি বইটা থিকা, তাইলে হয়তো বোঝা যাইতে পারে:

১. “শব-ই-বরাতের সন্ধ্যায় কেউ তেঘরিয়া এলে ভাবতে পারেন, তা হলে কি আজ দেওয়ালি?” (পৃষ্টা – ৩৩)।

২. “বরং শব-ই-বরাতের এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে মিল রয়েছে রান্নাপুজোর।“ (পৃষ্টা – ৩৫)

৩. “চন্দনের ফোঁটা ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী নেওয়ার কোনও কারণ নেই। তা হলে কেন?” (পৃষ্টা – ৩৬)

‘কারণ’টা হইলো এরা ত আসলে ‘ধর্মান্তরিত মুসলমান’, মানে আগেরকার হিন্দু। অরা মুসলমান হইলেও হিন্দু-ভাব ছাড়তে পারে নাই। সুতরাং অল্টারনেটিভ হিন্দু হিসাবে এই মুসলমান বাঙালি’রে দেখার বা লোকচারের ভিত্তি’তে মুসলমান বাঙালি যে হিন্দু বাঙালিরই একটা এক্সটেনশন – এই প্রস্তাবই বইটার মূল ভাবনা।

এইটা মোটেই কোন ভয়ংকর ব্যাপার না। ‘ভয়ংকর’ তখনই লাগছে যখন ফিল করছি যে, যিনি লিখছেন তিনি এইটা সর্ম্পকে মোটেই এওয়ার না। মানে, এই বিষয়ে উনার কোন পলিটিক্যাল এওয়ারনেসের কোন জায়গা দেখি নাই। উনি ধর্ম-এর বিবেচনা করতেছেন মোটামুটি একটা অ-ধার্মিক (সেক্যুলার) এর জায়গা থিকা; যেইটা আসলে না-হিন্দু, না-মুসলমান, বরং ক্রিশ্চিয়ানিটি’র জায়গা; যা প্রত্যক্ষভাবে ক্রিশ্চিয়ানিটি’র একটা হিন্দু রূপ, যদি ধর্মের জায়গা থিকা দেখতে চাই। (মানে আমি এইভাবে ভাবতে পারলাম আর কি!) Continue reading